শিরোনাম

কালীঘাটের পটচিত্রের সেকাল-একাল

কালিঘাট পটচিত্র  
ক্থায় আছে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। এই তেরো পার্বণের সিংহ ভাগই হচ্ছে বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা-অর্চনা। আর দেব-দেবী গড়ার আদি এবং অন্যতম স্থান হলো কালীঘাটের পটুয়া পাড়া।
বাংলার প্রাচীন লোকগাঁথা বর্ণনের ইতিহাসে পটশিল্পের উপস্থিতি বিশেষভাবে প্রাধাণ্য পায়। আর এই ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে কালীঘাটের পটশিল্পের নাম। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে বিলুপ্তের পথ ধরে আজ এই শিল্প ইতিহাসের পাতাতেই আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে।
ঊনবিংশ শতকের গোড়া থেকেই কালীঘাট মন্দির পৃথিবীর মানচিত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। এরই সাথে মন্দির সংলগ্ন এলাকায় কিছু চিত্র শিল্পী মাটির সড়ার উপর ছবি এঁকে এক বিশেষ ধরনের চিত্র শিল্পের প্রচলন করে। যা পরবর্তীকালে পটচিত্র নামে প্রচলিত হয়। আর পটচিত্রের সাথে যুক্ত শিল্পীদের পটুয়া আখ্যান দেওয়া হয়।
দুলাল চিত্রকর 

প্রধাণতঃ মেদেনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া থেকে রুজির টানে চিত্র শিল্পীরা কোলকাতায় চলে আসে। কোলকাতায় এদের স্থায়ী ঠিকানা হয় কালীঘাট। ধীরে ধীরে গড়ে তোলে কালীঘাটের পটুয়া পাড়া।
এই চিত্রের মূল বিষয় ছিল প্রধাণতঃ শহর কেন্দ্রিক কার্যকলাপ। তৎকালীন বাবু সমাজের কীর্তিকলাপ ব্যাঙ্গাত্মক অর্থে বর্নণা করাই ছিল এই চিত্র শিল্পের বিশেষ দ্রস্টব্য। অবশ্য চাহিদা অনুযায়ী পৌরাণিক কাহিনীর নানান বর্ণনাও উঠে এসেছে পটুয়াদের তুলির টানে। এছাড়াও আর্থসামাজিক অবস্থান ও বাঙালির ধর্মীয় চিন্তা-ভাবনাও এই শিল্পের মূল ধারায় জায়গা করে নিয়েছিল। বিধবার ঠাকুর ঘরে মাছ, বিড়ালের কোলে মাছ, লাস্যময়ী নারীর শারীরিক অবয়বের বহিঃপ্রকাশ ও বাঙালির দৈনন্দিন জীবনের নানান ঘটনার প্রতিচ্ছবি এই শিল্পীদের শিল্প সত্বাকে এক বৈপ্লবিক মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ করে। এই চিত্রকরেরা তাঁদের তুলির টানে গড়ে তোলে নতুন এক মৌলিক ও স্বতন্ত্র শিল্প কলা।
তদানীন্তন ইংরাজ সরকার ও বাঙালি সমাজের দৌলতমন্দ শিক্ষিত বাবুসমাজ, পট চিত্রকরদের কাছ থেকে নামমাত্র মূল্যে পটচিত্র কিনে ঘরের শোভা বর্ধনের কাজে ব্যাবহার করলেও পটুয়াদের আর্থিক বা নৈতিক উন্নতি স্বাধনে কোনও প্রকার দৃস্টি নিক্ষেপ করার প্রয়োজন বোধ করেননি কখনও। এই যৎসামান্য কেনা-বেচার মাধ্যমে চলতে থাকে পটুয়াদের রুজি-রোজগারের জীবন সংগ্রাম।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দলোন বৃদ্ধির সাথে সাথে অবসান ঘটে বাবুসমাজের। ফলে পটুয়াদের তৈরি শিল্পের বাজারও হ্রাস পেতে শুরু করে। স্বাধীনতা উত্তর কালেও এই পটুয়াদের জীবনধারা উন্নতির কোনও সুরাহা হয়না। ধীরে ধীরে পেটের টানে মৃৎশিল্পকেই রুজি-রোজগারের একমাত্র হাতিয়ার হিসাবে বেছে নিতে বাধ্য হয়। পটচিত্রের পাশাপাশি শুরু হয় দেব-দেবীর মূর্তি গড়ার কাজও।
আজকেও পটুয়া পাড়ার ছোট্ট পরিসরে গেলে দেখা যায় কি নিদারুন দারিদ্রে কাটছে এদের জীবন। বেশীরভাগ পটুয়ারাই গ্রাসাচ্ছাদনের তাগিদে পাড়ি দিচ্ছেন ভিন রাজ্যে। কেউ বা কাজ করছেন সোনার আড়তে অথবা কেউ যোগ দিচ্ছেন ইমারতী শিল্পে। যে কয়েকজন রয়ে গেছেন  তাঁদের ভাগ্যে বঞ্চনা ছাড়া আর  কোনও শিঁকেই ছিড়ছেনা। শিক্ষা-স্বাস্থের এতটুখানি বরাতও জোটেনি এদের ভাগ্যে। এমনকি মূর্তি তৈরি করার জন্য নূন্যতম জায়গাটা দরকার সেটারও সহায় নেই এদের সম্বলে।
গোপাল চিত্রকর 
যে প্রাকৃতিক রঙের সাহায্যে তাঁরা এককালে বিপ্লব ঘটিয়েছিল সেই রঙের সরঞ্জাম কিনতে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় এদের। পটুয়া পাড়ার এক বর্ষীয়ান চিত্রকর শ্রী দুলাল চিত্রকরের কথায় বিভিন্ন পূজা-পার্বণের আগে মুর্তি তৈরি করার বায়না মুর্তি তৈরি করার সরঞ্জাম কেনার টাকাই জোগাড় করে উঠতে পারিনা আমরা। রঙের দাম দিন দিন যে ভাবে বাড়ছে তা আমাদের সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র কূটীর শিল্পে সরকারের বিভিন্ন যোজনা প্রকল্প থাকলেও কালীঘাটের প্টুয়াদের কখনই যথার্থভাবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি তাতে। সরকারের কাছে সাহায্যের বদলে জুটেছে কেবলই আশ্বাস।
এক সময় শৌখিনতার সামগ্রী প্রস্তুত কারক হিসেবে পরিচিতি ও কদর থাকলেও আজ এদের সামাজিক অস্তিত্বটিই এক বিরাট প্রশ্ন চিহ্নের সম্মুখিন। শুধু মাঝে মাঝে কিছু জড়ভরত সন্মান উঠে এসেছে শিরিসচন্দ্র চিত্রকরের (রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত) মতোন দু-এক জনের হাতে। কিন্তু এই পুরস্কারে মন ও মান ভরলেও পেট কখনই ভরেনা।
আদি জীবিকা-পটচিত্র


সংস্কৃতি মনস্ক বাঙালি, মাছ-ভাতের স্বাদ গ্রহনকারী বাঙালি, বারো মাসের তেরো পার্বণের ঘেরাটোপে অহরহ চেটেপুটে নেওয়া বাঙালি কতটা খোঁজ রাখে আমাদের একান্ত নিজের কিছু ভাবধারা যা পাশের বাড়ির মেয়ের আদলেই লালিত হয়েছে। মাঝে-সাঝে দু-চারটে প্রদর্শনীতে জাঁক দেখানোর লড়াইয়ের জন্য ধার করে নেওয়া এই শিল্পী গুলির পরিশ্রমকে কি সঠিক অর্থে পারশ্রমিকের তালিকায় নির্ধারন করা হয়? আমরা যতটা মাদাম ত্রুঁসোর মিউজিয়ামে নতুন কারিগরি দেখতে উৎসাহ বোধ করি, ঠিক তার সিকি ভাগও যদি এই অকাল কুষমন্ড শিল্পী গুলির কপালে জোটে তাহলে বর্তে কালীঘাটের পটুয়াপাড়ার অলি-গলির আঁনাচে-কাঁনাচে থাকা করুন মুখের রেখা গুলি।  
******************
ছবি ও লেখা- অর্ণব দাশগুপ্ত   
[পরিচিতি- মাস কমিউনিকেশন নিয়ে পড়াশুনা। বহুদিন মিডিয়া ফিল্ডের সাথে যুক্ত। বর্তমানে ফটোগ্রাফি ও লেখা-লেখি নিয়ে ব্যস্ত। যার ফল স্বরূপ আজকের এই লেখাটি]

0 comments: