নীলচে সবুজ পাহাড় গুলোর মাঝে এক টুকরো
মখমলের মত মাঠ। কানায় কানায় পূর্ণ গ্যালারীর প্রতিটি চোখ এখন সেই প্রবাদ পুরুষটির
ওপর নিবদ্ধ।তার পদার্পণের সহর্ষ অভিবাদন পাহাড়ের বুক জুড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে আকাশে
মিলিয়ে গিয়েছে খানিক আগে। এখন মাঠ ময় শুধু বিমুগ্ধ নীরবতা। জীবনে শেষবারের মতো
গার্ড নিলেন তিনি। আম্পায়ারকে ধন্যবাদ জানিয়ে এক মুহূর্ত চোখ বুজলেন। বুঝতে পারলেন
ঝোড়ো হাওয়া ও সবুজ উইকেট আজ শেষ ইনিংসেও
তার পরীক্ষা নেবে। বল হাতে প্রস্তুত এক অনামী তরুণ, যার মধ্যে ভবিষ্যতের তারকা হওয়ার চিহ্ন স্পষ্ট। মূলত তার দাপটেই এখন
স্কোর বোর্ডে ১৪-২। ছেলেটিকে পছন্দ হয়েছে তার। তার প্রিয়তম খেলাটির রাজদণ্ড এমন
তরুণদের হাতে ছেড়ে দিয়ে যেতে পারবেন ভেবে নিশ্চিন্ত বোধ করলেন তিনি। নীলচে ধুসর
টুপিতে হাত চলে গেল স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে। দৃষ্টি নেমে এলো ক্রিজের দিকে। শুধু
এইটুকুতেই আপামর ক্রিকেট প্রেমী তাকে অব্যর্থ চিনে নেবে।ছেলেটি দৌড় শুরু করেছে।
সবুজ ঘাস চিরে হরিণের ক্ষিপ্রতায় ছুটে আসছে সে। লাল টুকটুকে বলটা বিদ্যুৎ বেগে সেই
হাত থেকে বেরিয়ে এলো।হাওয়ায় বাঁক নিয়ে অফ ষ্ট্যাম্পের একটু বাইরে গুড লেংথের কাছে
আছড়ে পড়ার মুখে শরীরটা মুচড়ে আরেকটা বিপজ্জনক বাঁক নিল। কিন্তু ততক্ষণে তার পা চলে
গিয়েছে বলের দিকে, আর ব্যাটের আলতো দোলা এগিয়ে চলেছে বলের
পূর্বনির্ধারিত পথে।
একটি আতঙ্কের স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে
নেমে এলো সমস্ত গ্যালারীতে। আজ তাদের
চোখের সামনে এক অমর মহাকাব্যের শেষ পৃষ্ঠাটি সংযোজিত হচ্ছে। কিন্তু কে না জানে, ক্রিকেট বিধাতা তার প্রিয়তম সন্তানদের সামান্যতম ভুলও
ক্ষমা করেন না। ক্ষমা ও দয়ায় অধিকার শুধু সাধারণের।
মহানায়কেরা সে কৃপা হতে বঞ্চিত।
ব্যাটে বল লাগার পরিচিত একটি শব্দ
হলো। সবুজ উপত্যকার ওপর একটি পাহাড়ী নদীর মত বয়ে গেল বলটি। পয়েন্ট ও কভারে তখন
স্থাণুবৎ দণ্ডায়মান দুই গ্রীক ভাস্কর্য।
সেদিন অপরাহ্ণে অপরাজিত শতরানে দলকে
জিতিয়ে সহর্ষ উল্লাস ও অশ্রু জোয়ারে ভেসে ক্রিকেটের মাঠকে চিরবিদায় জানালেন ভিক্টর
ট্রাম্পার।ঘটনা ও আবেগ মুখর সেই দিনের শেষে একান্তে ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়ে তিনি
দেখলেন সেই তরুণ দাড়িয়ে তার প্রতীক্ষায়। তার বাড়িয়ে দেওয়া বলে সই করে তাকে জড়িয়ে
ধরলেন ক্রিকেটের প্রবাদ পুরুষ । তার কথাগুলো তার কভার ড্রাইভ-এর মতই চিরকাল গেঁথে
রইলো তরুণটির মনে
"শুধু একটা কথা মনে রেখো।
ক্রিকেট শুধুমাত্র কোনো খেলা নয়। ক্রিকেট একটা প্রবহমান ঐতিহ্য, একটা অন্য জীবন। আজ থেকে বহু
বছর পর ক্রিকেটের কোনো রাজার কুমার যখন সারা বিশ্ব জয় করে সব শেষে একান্তে ওই ২২
গজের সামনে এসে দাঁড়াবে, তখন তার তুলে নেওয়া মাটিতে
আমাদের সবার ছোঁয়া থাকবে। "
***************
শিবতোষ সিনহা
|
[পরিচিতি-পেশাগতভাবে শিক্ষকতা দিয়ে শুরু করে তারপর
সফটওয়্যার ইঞ্জিনীয়ার; আর নেশাগত ভাবে সাহিত্যরসিক এবং লেখক।
সঙ্গীত ও নাট্যপ্রেমী। লেখার শুরু সেই ছোটবেলায় বাড়ির খাতার পিছনের পাতা থেকে। সেই
থেকে আজ অবধি ভাবনা আর স্বপ্নের আঁকিবুকি আলপনা চলছে।]
shibatosh@rediffmail.com
No comments:
Post a Comment