Friday, 6 February 2015

ভাবো ভাবো ভাবা প্র্যাকটিস কর

ঋত্বিক ঘটক-এর কম বয়সের ছবি, ছবি- গুগল 
বাংলা চলচ্চিত্রের আকাশ যে কয়েকজন নক্ষত্রের আলোতে আলোকিত,ঋত্বিক ঘটক তাঁদের মধ্যে অন্যতম। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন চলচ্চিত্র প্রেমীদের কাছে তাঁর পরিচালিত ছবিগুলো একেকটি ইতিহাস হয়ে আছে। তিনি ছিলেন যুগ সচেতন চলচ্চিত্রকার এবং এ ছাড়াও গল্পকার,নাট্যকার এবং অভিনেতাসহ দৃশ্যশিল্পের প্রায় সব রূপেই ছিলেন এক মহামানব।
এই কিংবদন্তী চলচ্চিত্রকারের জন্ম ১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর ঢাকার ঋষিকেশ দাশ লেনে ঐতিহ্যময় ঘটক বংশে।তিনি ইন্দুবালা দেবী ও সুরেশ চন্দ্র ঘটক দম্পতির ১১তম এবং কনিষ্ঠতম সন্তান।ঋত্বিক ঘটকের বংশের আদি পুরুষ পণ্ডিত কবি ভট্ট নারায়ণ। মানুষকে তিনি দেখেছেন, মানুষের সংগ্রাম নিয়ে তিনি ভেবেছেন, পীড়িত মানুষের দুঃখে তিনি কেঁদেছেন, আর তাইতো মাত্র অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র অবস্থাতেই শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে তিনি জড়িয়ে পড়েন।
১৯৪৭ দেশ ভাগের সময় ঋত্বিক ঘটক ও তাঁর পরিবার কলকাতায় পাড়ি জমান।তিনি রাজশাহী কলেজে পড়া অবস্থায় নাটক শুরু করেন।ঋত্বিক ঘটক তাঁর প্রথম নাটক কালো সায়র লেখেন ১৯৪৮ সালে। একই বছর তিনি নবান্ন নামক পুনর্জাগরণমূলক নাটকে অংশ গ্রহণ করেন।এরই মাঝে তিনি নাটকের প্রতি এতই আকৃষ্ট হয়ে পড়ে যে ১৯৪৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি হয়েও এই নাটকের নেশাতেই পড়া-লেখা ছেড়ে দেন।
১৯৫১ সালে তিনি ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘে যোগদান করেন। এসময় তিনি অনেক নাটক লিখেন,অভিনয় করেন ও নির্দেশনা দেয়। ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির আন্দোলনর ফসল হিসেবে ১৯৫০ সালের শুরুতে কলকাতায় শুরু হয় বিশ্বের ধ্রুপদ এবং অন্যান্য ভালো ছবি দেখানো।এসময় তিনি ছবি নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করলেন এবং বুঝতে পারলেন জনমানুষের বড় অংশের কাছে নিজের বক্তব্য তুলে ধরার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার চলচ্চিত্র।এই বোধ থেকে উদ্বুদ্ধ হয়েই নিমাই ঘোষের ছিন্নমূল চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সেলুলয়েড দুনিয়াতে প্রবেশ ঘটে ঋত্বিক ঘটকের।এই ছবিতে তিনি একই সাথে অভিনয় করেন এবং সহকারী পরিচালক হিসাবে কাজ করেন। ঋত্বিকের প্রথম সৃষ্টি 'নাগরিক'।১৯৫২ সালে তার একক পরিচালনায় তৈরি হয় নাগরিক চলচ্চিত্রটি।কিন্তু সব থেকে দুঃখের বিষয় হচ্ছে ছবিটি তাঁর জীবদ্দশায় মুক্তি পায়নি। এরপর ১৯৫৭ সালে নির্মিত হয় ঋত্বিকের প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র 'অযান্ত্রিক'। এরপর ঋত্বিক শরণার্থীদের নিয়ে তার ট্রিলজি নির্মাণ করেন মেঘে ঢাকা তারা(১৯৬০) কোমল গান্ধার(১৯৬১) ও সুবর্ণরেখা(১৯৬২)। ১৯৬৫ সালে সুবর্ণরেখা মুক্তি পাবার পর আট বছরের বিরতি নেন ঋত্বিক।এরপর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে এসে নির্মাণ করেন তাঁর বিখ্যাত চলচ্চিত্র 'তিতাস একটি নদীর নাম'।এটি ভারত বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত হয়।এর মাঝে ১৯৬৬/৬৭-র দিকে কিছুদিন তিনি পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউশনের অধ্যক্ষ ছিলেন।মুম্বাই-এর হিন্দি ছবিতে চিত্রনাট্য রচনার কাজও তিনি করেছেন।এরপর অনেক দিন তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন মানসিক হাসপাতালে।এরপর ১৯৭৬-এর ৬ই ফেব্রুয়ারি মাত্র ৫০ বছর বয়সে চলচ্চিত্রের এই মহামানব পশ্চিম বঙ্গের কলকাতায় পরলোকগমন করেন।ইহজগৎ থেকে তিনি ছুটি নিলেও, তাঁর সৃষ্টি ছবিগুলো আজও চলচ্চিত্র জগতের সম্পদ।

এরপর ১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় ঋত্বিকের শেষ ছবি 'যুক্তিতক্ক আর গপ্পো'। কাহিনীর ছলে তিনি নিজের কথা বলে গেছেন এ ছবিতে। ঋত্বিক যে মানের নির্মাতা ছিল তাঁর যোগ্য সন্মান সে সময় তিনি পায়নি,তাই তো তাঁর সময়ের অনেক কুখ্যাত নির্মাতাও তাঁর থেকে বেশি পদক পেয়ছে।কিন্তু ঋত্বিকরা যুগে যুগে একবারই জন্মায় এবং তাঁরা পদক পাবার জন্য কাজ করে না,তাঁরা নিজের মনের তাগিদে,সমাজের তাগিদে কাজ করে যায়।এবং কাজের মাধ্যমেই তাঁরা নিজেদের প্রমাণ করে যায়।আর তাই তো আজ চলচ্চিত্র জগৎ-এর প্রতিটি মানুষের কাছে তাঁর ছবি শিক্ষার এক অবিচ্ছেদ মাধ্যম হয়ে থেকে গিয়েছে। 

No comments:

Post a Comment