Tuesday 31 March 2015

অন্য নিউটন

গডফ্রে নেলার কর্তৃক স্যার আইজাক নিউটনের 
৪৬ বছর বয়সের স্থির প্রতিকৃতি,ছবি- গুগল
জন্মলগ্ন থেকে তিনি ছিলেন রুগ্ন প্রকৃতির এক বালক। অথচ স্কুলে দুষ্টুমিতে সেরা ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও শিক্ষকগণ মুগ্ধ ছিল তাঁর অসাধারণ জ্ঞান প্রতিভায়। অসাধারণ মেধাবী সেই বিজ্ঞানী হচ্ছেন স্যার আইজাক নিউটন। তিনি ছিলেন একাধারে পদার্থবিজ্ঞানী,গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী,প্রাকৃতিক দার্শনিক,আলকেমিস্ট।
স্যার আইজাক নিউটন ইংল্যান্ড ৪ জানুয়ারী,১৬৪৩ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। জাতীতে তিনি ছিলেন ইংরেজ। ট্রিনিটি কলেজ,কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেন। মূলত নিউটনের আগ্রহ ছিল গণিত ও বলবিজ্ঞানের উপর। ট্রিনিটি কলেজে তিনি কেপলারের আলোকবিজ্ঞান বিষয়ক সূত্রের উপর অধ্যয়ন করেন। এরপর তিনি ইউক্লিডের জ্যামিতির প্রতি পড়াশুনায় অধিক মনোযোগ দেন। স্নাতক শিক্ষা গ্রহণকালে নিউটনের কিছু নিবন্ধের অনুসন্ধান পাওয়া যায়। ১৬৬৫ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভের সময়ে নিউটন তার বিখ্যাত দ্বিপদী উপপাদ্য বিষয়ক সূত্র প্রমাণ করেন। ঠিক একই সময়ে ফ্লাকসিয়নের পদ্ধতি আবিষ্কার বিষয়ক প্রথম তত্ত্ব প্রদান করেন। লিংকনশায়ারে নিউটন গবেষণা চালিয়ে যেতে থাকেন। এখানে এসে রসায়ন এবং আলোকবিজ্ঞান বিষয়ের উপর বিভিন্ন পরীক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন। একই সাথে চালিয়ে যেতে থাকেন তাঁর গণিত বিষয়ক অধ্যয়ন। ১৯৬৬ সালে নিউটন তাঁর মহাকর্ষ তত্ত্ব আবিষ্কারের সূচনা করেছিলেন।
উল্‌সথর্প ম্যানরে নিউটনের বাড়ি, ছবি- গুগল
১৬৪৭ সালে ১৬৪৭ সালে Philosophiac Naturalis pricipia Mathmatica  প্রকাশিত হয়। এই বইয়ের প্রথম খণ্ডে নিউটন গতিসূত্র সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন। তিনটি গতিসূত্র হল-
১) প্রত্যেকটি বস্তু চিরকাল সরলরেখা অবলম্বন করে সমবেগে চলতে থাকে।
২) বস্তুর ওপর প্রযুক্ত বল বস্তুর ভরবেগের পরিবর্তনের হারের সমানুপাতিক এবং বল যেদিকে ক্রিয়া করে, ভরবেগের পরিবর্তনও সেদিকে ঘটে।
৩) প্রত্যেকটি ক্রিয়ার সমান বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।
দ্বিতীয় খণ্ডে নিউটন গ্যাস ও ফ্লুয়িড বস্তুর গতির কথা আলোচনা করেছেন। গ্যাসকে কতকগুলো স্থিতিস্থাপক অণুর সমষ্টি ধরে নিয়ে তিনি বয়েলের সূত্র প্রমাণ করেন। গ্যাসের উপর চাপের প্রভাব বিশ্লেষণ করতে গিয়ে পরোক্ষভাবে শব্দ তরঙ্গের গতিবেগও নির্ধারণ করেন।
তৃতীয় খণ্ডে মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব সম্বন্ধে খুঁটিনাটি বিষদভাবে আলোচনা করেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন মাধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবেই সূর্যকে কেন্দ্র করে গ্রহগুলো ঘুরছে। তেমনি পৃথিবীকে কেন্দ্র করে চাঁদ ঘুরছে।
প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামেটিকা বই, ছবি- গুগল

১৬৭১ সালে তিনি লন্ডনের রয়াল সোসাইটির সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৬৭২ সালে তাঁর প্রথম বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থ আলোক বিজ্ঞান প্রকাশিত হয়। ১৬৮৪-১৬৮৬ সালে তিনি লেখেন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ প্রিন্সপিয়া। ১৬৮৯ সালে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৬৯৬ সালে তিনি সরকারি টাকশালের ওয়ার্ডেন এবং পরে প্রধান পদ লাভ করেন। ১৭০৩ সালে নিউটন পেলেন এক অভূতপূর্ব সম্মান। তিনি রয়াল সোসাইটির সভাপতি হলেন। আমৃত্যু তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
অসম্ভব প্রতিভাশালী এই মানুষটিকে নিয়ে বেশ কিছু মজার ঘটনা প্রচলিত আছে,আজ তার মৃত্যু বার্ষিকীতে সেই সব ঘটনার কিছু উল্লেখ্য করা হল-
·        নিউটন যখন ছোট ছিলেন একদিন তিনি লক্ষ্য  করেন স্কুলের অধ্যক্ষের শ্যালক প্রায়ই স্কুলে আসতে দেরি করতেন। চিন্তা করতে করতে হঠাৎ তাঁর মাথায় বুদ্ধি আসলো। সেই মুহূর্তে নিউটন বলে উঠলেন,স্যার আপনার জন্য একটা ঘড়ি তৈরি করে দিচ্ছি যা দিয়ে ঠিক সময়ে স্কুলে আসতে পারবেন। কিন্তু নিউটন ঘড়িটা তৈরি করলেন কিভাবে? তিনি যে ঘড়িটা তৈরি করলেন সেই ঘড়ির উপরে থাকতো জলের পাত্র। প্রতিদিন নির্দিষ্ট ফোঁটা ফোঁটা জল ঘড়ির কাঁটার উপরে পড়ত। এর ফলে ঘড়ির কাঁটা নিজের গতিতে এগিয়ে চলতো সামনের দিকে। এভাবে সময় গণনা করা হতো।
·        এক রাতে নিউটন বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করেছেন। অথচ তিনি একদম ভুলে গিয়েছিলেন। গণিতের এক জটিল সমস্যা সমাধানে তিনি গভীর মগ্নতায় ডুবে ছিলেন। বন্ধুটি যথাসময়ে এসে তা লক্ষ্য করলেন। ফলে চুপচাপ বসে রইলেন তাঁর অপেক্ষায়। বেশ কিছুক্ষণ পর খাবার এলো। শুধু একজনের খাবার। বন্ধুটি মনে করলেন,তার জন্যই এ খাবার আনা হয়েছে। বন্ধুটি নিউটনকে বিরক্ত না করে চুপচাপ খাবার খেয়ে ফেললেন। এর কিছুক্ষণ পর গণিতের সমাধান শেষ করে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে তো রীতিমত অবাক। এবার তাঁর খেয়াল হলো,বন্ধুকে আমন্ত্রণের  কথা ভুলেই গিয়েছিলেন। খাবার বিহীন প্লেটের দিকে নজর পড়তেই বন্ধুকে বললেন,ভাগ্যিস তুমি এসেছো। নইলে তো বুঝতেই পারতাম না যে আমি এখনো খাইনি
·        বিজ্ঞানী ও সাধকগণ কখনো কখনো এমন আত্মমগ্নতায় বিভোর হন অন্য সবকিছুই ভুলে যান সেই সাধনার মুহূর্তে। এমনভাবে নিউটন কোন নতুন বৈজ্ঞানিক ভাবনায় ডুবে থাকতেন। আরও একদিনের ঘটনা। একজন লোক তাঁর বাড়িতে এসে একটা প্রিজম (তিনকোণা কাঁচ) দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এর দাম কত হতে পারে। সেই ব্যক্তি নিউটনের কাছে এই প্রিজমটি বিক্রির জন্যই এসেছিল। এ সময় নিউটন প্রিজমের বৈজ্ঞানিক গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে বললেন, এর প্রকৃত মূল্য নির্ণয় করা তাঁর সাধ্যের বাইরে। ফলে লোকটি বেশি দাম চাইল। নিউটন সেই দামেই প্রিজমটি কিনে ফেললেন। তোমরা জেনে অবাক হবে, পরবর্তীকালে এই প্রিজম থেকে তিনি উদ্ভাবন করেন বর্ণতত্ত্ব (The theory of color)|
ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবে-তে নিউটনের সমাধিস্থল,ছবি- গুগল
 ১৭২৭ সাল,নিউটন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। চিকিৎসাতে কোনো সুফল পাওয়া গেল না। অবশেষে ৩১ মার্চ (গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জী ) মহাবিজ্ঞানী নিউটন তার প্রিয় অনন্ত বিশ্বপ্রকৃতির বুকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেলেন। সাত দিন পর তাকে ওয়েস্ট মিনস্টার অ্যাবিতে সমাধিস্থ করা হলো।
সমস্ত দেশ অবনত মস্তকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানায় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এই জ্ঞানতাপসকে। যদিও নিজেকে তিনি কখনো পণ্ডিত বা জ্ঞানী ভাবেননি। মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে তিনি লিখেছিলেন, পৃথিবীর মানুষ আমাকে কি ভাবে জানি না কিন্তু নিজের সম্বন্ধে আমি মনে করি আমি একটা ছোট ছেলের মতো সাগরের তীরে খেলা করছি আর খুঁজে ফিরেছি সাধারণের চেয়ে সামান্য আলাদা পাথরের নুড়ি বা ঝিনুকের খোলা। সামনে আমার পড়ে রয়েছে অনাবিষ্কৃত বিশাল জ্ঞানের সাগর।

No comments:

Post a Comment